[বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি প্রতিরোধ্যে আশুলিয়া মহিলা ও শিশু হাসপাতাল]
ডিসেম্বর ২০২২
আশুলিয়া মহিলা ও শিশু হাসপাতাল থেকে প্রণীত
সিজারিয়ান ডেলিভারি (সি-সেকশন) গুরুত্বপূর্ণ একটি সার্জিকাল প্রক্রিয়া, যেখানে মাতৃ ও শিশু স্বাস্খ্য ভিত্তিক সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা আবশ্যক। যখন গর্ভকালীন জটিলতাগুলো মা ও শিশুর জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালো, তখন একটি নিরাপদ জন্মদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে উদ্ভাবিত হয় সিজারিয়ান ডেলিভারি। সিজারিয়ান ডেলিভারি সময়মতো করা হলে তা মাতৃ মৃত্যু, প্রসূতি ফিস্টুলা, জরায়ুর স্থানচ্যূতি এবং যৌন অসন্তুষ্টির মতো প্রসূতিকালীন ঝুঁকি প্রতিরোধের সোনালি সুযোগ বয়ে আনতে পারে। তবে সিজারিয়ান ডেলিভারির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে, বিশেষত যেসব দেশের স্বাস্থ্য সুবিধা অপর্যাপ্ত। গবেষণায় দেখা যায়, মোট জনসংখ্যার ১০% এর বেশি সি-সেকশন প্রসবের হার মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুর হার হ্রাসের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং সি-সেকশন ডেলিভারি বৃদ্ধির সাথে সাথে অকাল প্রসব এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, কোনও দেশে সি-সেকশন ডেলিভারি মোট প্রসবের ১০% থেকে ১৫% এর বেশি হওয়ার কোনও যৌক্তিক কারণ নেই। তবে, যে কোন জনসংখ্যার ৫% এরও কম সিজারিয়ান ডেলিভারি হলে তা প্রসবপূর্ণ এবং মাতৃকালীন যত্নের ঘাটতি রয়েছে বলেই ইঙ্গিত প্রদান করে। (ডব্লিউএইচও, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, মাইলাম স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড এএমডিডি, ২০০৯).
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে , বিশেষ করে মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে । ১৯৯০/৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৫৭৪ জন (প্রতি ১লাখে), যা ২০১৫ সালে নেমে আসে ১৪৩ জনে । প্রসবকালীন দক্ষ স্বাস্থ্য পেশাদারদের অংশগ্রহণের অনপুাত ১৯৯০/৯১ সালে ছিল মাত্র পাঁচ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে এসে ৫০ শতাংশে উন্নীত হয় এবং প্রসবর্পূব যত্ন ও পরির্চযাও (কমপক্ষে চারটি ভিজিট) একই মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার প্রায় আটগুণ বৃদ্ধি পায়। ২০০৪ সালে এই হার ছিল ৪ শতাংশে । তবে , সাম্প্রতিক একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে , ২০১৭-১৮ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারির এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশে (বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ-বিডি এইচএস)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতি বেশী দেশগুলো দ্বারা নির্ধারিত মানও অতিক্রম করেছে । দেখা যায় যে, সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ভারতে ২২ শতাংশ (২০১৯-২০২১), পাকিস্তানে ২২ শতাংশ (২০১৭-২০১৮), নেপালে ১৬ শতাংশ
(২০১৬), এবং মায়ানমারে ১৭ শতাংশ (২০১৫-২০১৬) শতাংশ। এমতাবস্থায়, অপ্রয়োজনীয় সি -সেকশনের ব্যাপকতা বাংলাদেশে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
বলা হয়ে থাকে যে, নারীরা স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতার সম্মুখীন হন, তবে গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে যেম স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সি-সেকশনে জটিলতার হার অনেক বেশি। যেকোনো অস্ত্রোপাচারের মতো, সি-সেকশন মা ও তার শিশুর জন্য গুরুতর ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে নারীরা সাধারণত সবচেয়ে বেশি যে জটিলতাগুলোর সম্মুখীন হন, তা হলো সংক্রমণ, জ্বর, অস্বাভাবিক রক্তপাত, পেশী ব্যথা, মাথাব্যথা এবং অ্যানেস্থশিয়ার ঝুঁকি। একটি সি-সেকশন পরবর্তী গর্ভধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুতর ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, যার মধ্যে ভবিষ্যৎ সন্তান ধারণ করতে অক্ষম হওয়ার সম্ভাবনাও অন্তর্ভুক্ত।
সেইভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ” এর তথ্যমতে, জাতীয়ভাবে ২০১৬ সালে প্রায় ৮২০,৫১২ টি সি-সেকশন করা হয়েছিলো এবং যার মধ্যে ৫৭১,৮৭২ টি ছিল। অধিকন্তু, এটিও দেখায় যে বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ৮০ শতাংশ প্রসবে এখন অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে হচ্ছে।
চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও সিজারিয়ান ডেলিভারি অর্থনৈতিকভাবেও নারীদেরকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। সেইভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ এর মতে , ২০১৮ সালে বাংলাদেশি বাবা-মায়েরা অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের জন্য চিকিৎসা বাবদ ৪,০৭১,০৩১,২০০ টাকা খরচ করেছেন, যা গড়ে প্রতিটি সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য ৫১,৯০৫ টাকা। এক্ষেত্রে, একটি সি-সেকশনের জন্য গড় খরচ ছিল ৪০,০০০ টাকা, যেখানে একটি সাধারণ ডেলিভারির ছিল মাত্র ৩,৫৬৫ টাকা।
ইতিহাস বলছে, গর্ভবতী মায়েরা ততোক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের শরীর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে কখন তিনি জন্ম দেয়ার জন্য প্রস্তুত এবং জন্মের প্রক্রিয়াটি কতক্ষণ পর্যন্ত চলবে। তারপরেও, কেন কিছু মা এত অপ্রতিরোধ্য হারে স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে অস্ত্রোপচারকে বেছে নিচ্ছেন? আমরা জানি, অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে প্রসব প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত অপ্রত্যাশিত সময়ের পরিবর্তে, একটি সুবিধাজনক সময়ে জন্মদান সম্পন্ন করার সুবিধা দেয়। আমরা এরকম ধারণাও দেখতে পেয়েছি, যেখানে মনে করা হয় প্রাকৃতিক প্রসবের চেয়ে সি-সেকশনই একমাত্র ’ভাল’। স্বাস্থ্য খাত থেকে এই মনোভাবের সাথে সম্পৃক্ত অবশ্যই কিছু চাপ প্রয়োগ করা হয় বলে মনে করা হচ্ছে। কিছু মায়েরা, হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়া বেছে নেন এবং তারা অস্ত্রোপচার না করার জন্য তাদের প্রসবের সময় মৌখিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
’বাংলাদেশে সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারি’ শীর্ষক গবেষণাটি জার্নাল অব বাংলাদেশ স্টাডিজে (জেবিএস) প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (বিডিআই) এর ভলিউম ২১ এবং ২নং-এ, বাংলাদেশে সি-সেকশন ডেলিভারির ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় শিক্ষা এবং সম্পদের ভূমিকাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটি এই ধরনের প্রসবের সাথে সম্পর্কিত কারণগুলো অনুসন্ধান করে; যেমন প্রথম জন্মের সময় বয়স, বিভাগ (অঞ্চল), বসবাসের স্থান, শিক্ষাগত অবস্থান, যে কোনও মিডিয়াতে অ্যাক্সেস, উত্তরদাতার পারিবারিক সম্পদের পরিমাণ, জন্মের ক্রমধারা, প্রসবপূর্ব যত্ন সংক্রান্ত ভিসিটের ফ্রিকেয়েন্সি, বডি মাস ইনডেক্স এবং ডেলিভারির স্থান। বিশ্লেষণ অনুসারে, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত মায়েদের মধ্যে সিজারিয়ান প্রসবের প্রবণতা বেশি। ২০১৫ সালে উচ্চশিক্ষিত নারীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (৫৪.৮ শতাংশ) সি-সেকশন এর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করিয়েছেন, যেখানে অশিক্ষিত নারীদের শুধুমাত্র ৭.০ শতাংশ এই পদ্ধতির মাধ্যমে একটি সন্তান প্রসব করেন। এক্ষেত্রে তাদের স্বামীর শিক্ষাগত অবস্থানও একই ভূমিকা পালন করেছে।
নারীদের কর্মসংস্থানের দিক বিবেচনাতেও, যাদের সি-সেকশনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার মধ্যে ২৪.৬ শতাংশ নারী বেকার, যেখানে কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম (১৭.৪ শতাংশ)। দেশের অঞ্চলভেদেও সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। এক্ষেত্রে, দেখা গেছে যে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর (১৭.৬ শতাংশ) চেয়ে শহরাঞ্চলে (৩৮.১ শতাংশ) সি-সেকশন বেশি প্রচলিত। যেসব নারীদের মিডিয়া আউটলেটগুলোতে খুব কম অ্যাক্সেস রয়েছে বা নেই তাদের তুলনায়, যেসকল নারীরা রেডিও এবং টেলিভিশনের মতো মিডিয়াতে অ্যাক্সেস করেছেন তাদের এই চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করার সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি (১০.৫ শতাংশ বনাম ৩০.৭ শতাংশ)।
বিশেষ এই বিশ্লেষণীটিতে দেখা গেছে যে, সি-সেকশন প্রসবের হার সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে বেশি। যেখানে সরকারি হাসপাতালে সি-সেকশন প্রসবের হার ছিল ৩৭.২ শতাংশ, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে এ হার ৭৮.১ শতাংশ।
ইতিহাস পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পারি যে, গর্ভবতী মায়ের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার উপর নির্ভর করে সিজারিয়ান ডেলিভারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কিন্তু, বিশেষ কোনো চিকিৎসাগত আবশ্যকতা ছাড়াই, সি-সেকশনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে, নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিশদভাবে জানা জরুরি হয়ে উঠেছে।
মাতৃ ঝুঁকিঃ
যেকোনো বড় অস্ত্রোপচারের মতো, সিজারিয়ান ডেলিভারির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। সিজারিয়ান মায়েদের প্রধান ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
শিশুর ঝুঁকিঃ
সিজারিয়ান ডেলিভারি কখনও কখনও শিশুদের জন্য নিম্নলিখিত ঝুঁকির কারণ হতে পারেঃ
আশুলিয়া মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতাল (এডব্লিউসিএইচ) এর ব্যবস্থাপনা পর্ষদ অনাবশ্যক সি-সেকশনের সংখ্যা কমাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সমস্ত প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, অনাবশ্যক সি-সেকশসের সংখ্যা হ্রাস, এবং মায়েদেরকে প্রাকৃতিক ভ্যাজাইনাল ডেলিভারির প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে, আশুলিয়া মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্য্ (এডব্লিউসিএইচ) একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।